Monday, September 10, 2012

পুলিশ রিমান্ড মানেই নির্যাতন


পুলিশ রিমান্ড মানেই নির্যাতন
শিবব্রত
বাংলা একাডেমীর অভিধান অনুযায়ী রিমান্ড শব্দটির অর্থ আরও সাক্ষ্য প্রমান সংগ্রহের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে থেকে পুলিশের হেফাজতে পাঠানো। আর সংবিধান ফৌজদারী কার্যবিধি পুলিশ প্রবিধান সহ সব আইনেই পুলিশ হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে শারীরক ও মানসিক নির্যাতন করা অপরাধ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, বাংলাদেশে রিমান্ড মানেই নির্যাতন।
২০০৫ সালের ২৬ জুন ম্যাজিষ্টেটের সামনে জবাব বন্দি দেন জজ মিয়া। তাকে দিয়ে বলানো হয়েছিল সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নির্দ্দেশে তিনি সহ ১৪ জন ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট আওয়ামীলীগের সমাবেশে গ্রেনেড ছুড়েছিলেন। ১০ জুন গ্রেপ্তারের পর ১৫দিন পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সি আই ডি হেফাজতে নিয়ে জজ মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হন। পরে সি আই ডির ই তদন্তে বেরিয়ে আসে নির্যাতন করে ভয়ভীতি আর লোভ দেখিয়ে জজ মিয়াকে স্বীকারোক্ত দিতে বাধ্য করা হয়।
২০১০ সলের ১৯ শে এপ্রিল রাতের কোন এক সময় খুন হয় বংশাল থানার অপারেশন কর্মকর্তা গৌতম রায়। এই মামলায় হায়দার আলী ও জাকির হোসেন নামে দুই যুবককে ধরে ২৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব। তারা গৌতম রায়কে খুন করেছে বলে স্বীকার করে এবং ঘঠনার শাসরুদ্ধ কর বর্ণনা দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা মহা নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডি,বি) তদন্তে প্রমানিত হয়েছে এই হায়দার ও জাকির হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলনা। অভিযোগ পত্র থেকে তাদের নাম ও বাদ দেওয়া হয়েছে। আট মাসের ও বেশী সময় কারাগারে থাকার পর ছাড়া পায় হায়দার ও জাকির। পরে ওই দুুুুুুুুুুুুুুুুুই ব্যাক্তি প্রকাশ করে যে, পুলিশের নিমর্ম নির্যাতনের কারনে তারা গৌতিমকে হত্যার দায় স্বীকার করে ছিল। খিলগাঁও থানার সাবেক ভার প্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের অজু হাতে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের পায়ে চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়েছিল। গত বছর জুলাই মাসে রাতে মিথ্যা অভিযোগ কাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু জজ মিয়া, হায়দার জাকির বা কাদের নন। রিমান্ডের নামে শারীরিক মানসিক নির্যাতন স্বীকার হচ্ছেন অনেকেই। রিমান্ডে নিয়ে মারপিট করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বীকার রোক্তি আদায়ের ঘঠনা অহরহ ঘঠছে। তবে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পুলিশের এক কর্মদক্ষতা সংক্রান্ত এক সেমিনারে বলেন ‘পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের কোন আহন গত ভিত্তি নেই। বিধি বহির্ভূত ভাবে তদন্ত চালানোর এখাতিয়ার ও কারোর নেই। আইন শৃঙ্ঘলা রক্ষা বাহিনি এটা করতে পারেনা। জিজ্ঞাসা বাদের বিষয়ে পুলিশের বিধি আছে, সেই মোতাবেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হয়’। এদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন ‘আই জি পি যা-ই বলুন নির্যাতন পুলিশের প্রধান তদন্ত কৌশল। বাস্তবে এটাই আইন কর্মকর্তারা বলেছেন হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করা বেআইনি। প্রশিক্ষনের সময় পুলিশকে এটা শেখানো হলে ও কর্মক্ষেত্রে তার উল্টোটা হয়। কারন সাক্ষ্য আর স্বীকাররোক্তি ছাড়া পুলিশের কাছে আর কোন প্রমান না থাকায় মামলা খারিজ হয়ে যায়। তাই নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় ছাড়া কোন উপায় থাকেনা।  কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পেশাদার অপরাধীরা সহজে কিছু বলতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে আইন উপেক্ষা করে ও মারধর করতে হয়। তবে জিজ্ঞেসা বাদের ও বিভিন্ন কৌশল রয়েছে। অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তারা সেই কৌশল অবলম্বন করে তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত হতে পারেন। নির্যাতন কৌশলের মধ্যে রয়েছে ওয়াটার পলিশ (নাকে মুখে গামছা দিয়ে পানি ঢালা) বাদর ঝোলানো, ওয়াটার থেরাফি, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া গুলি করে হত্যার (এনকাউন্টার বা ক্রস ফায়ার) হুমকী ইত্যাদি।
আইনে যা আছেঃ
পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী, পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) বা তার ওপরের যেকোনো কর্মকর্তা মামলার তদন্ত করতে পারবেন। বাস্তবে তদন্তের সিংহভাগই করে থাকেন এ,এস,আইরা।
২০১০ সালে জুনে ঢাকা মহানগর পুলিশের হেফাজতে পর পর তিনজনের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। এরপর ডিএমপি কমিশনার আসামিদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন না করাসহ ১২ দফা নির্দেশনা দেন। তখন কর্মকর্তাদের মন্তব্য ছিল, নিদের্শনাগুলোতে নতুন কিছুই নেই। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ‘ভুলে যাওয়া’ আইন মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টামাত্র। ওই নির্দেশনায় আরও মনে করিয়ে দেওয়া হয়, সংবিধানের ৩৩ ও ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুসারে, আটক করা ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশ সচেষ্ট হবে।
সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারায় রয়েছে, ফৌজদারি মামলার যদি কোনো ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর প্রতীয়মান হয় যে ভয়ভীতি, প্রলোভন বা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে এবং আদালত যদি মনে করেন, এর ফলে আসামি কোনা পার্থিব সুবিধা পাবেন বলে ধারণা করেছিলেন, তবে আসামির সেই স্বীকারোক্তি অপ্রাসঙ্গিক।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৩ ধারায় রয়েছে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা সাক্ষ্য আইনে বর্ণিত ২৪ ধারা অনুযায়ী কোনো প্রকার প্রলোভন, হুমকি বা প্রতিশ্রুতি দেবেন না বা দেওয়াবেন না। এই অধ্যায় অনুসারে কোনো ব্যক্তি স্বাধীনভাবে বিবৃতি দিতে চাইলে কোনো কর্মকর্তা তাঁকে হুশিয়ারি বা অন্য কোনোভাবে বারণ করবেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর  রহমান বলেন, ঐতিহ্যগত ভাবে পুলিশের সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তিনির্ভর যে সনাতনী তদন্ত পদ্ধতি তা বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ব্রিটিশ আমলে পুলিশকে যে তদন্ত এখনো ব্যবহার করে আসছে। সেগুলোর পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। মানবাধিকারের বিষয়ে পৃথিবীর মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে মানবাধিকারের ধারণাটিই ছিল না।
২০০৩ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাষ্ট (ব্লাষ্ট) বনাম বাংলাদেশ মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কিছু দৃষ্টান্ত-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। মামলাটিতে পক্ষভুক্ত ছিল বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসকের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশে রিামান্ডে যে আচরণ করা হয়, তা একেবারেই বেআইনি। ২০০৩ সালের ওই  মামলার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই চর্চাটা এতটাই ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে শেষ পর্যন্ত আদালতকেও এ বিষয়ে রায় দিতে হয়েছে।
আইনজ্ঞ শাহ্দীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সেফ হাউসে অভিযুক্তদের স্বজন ও আইনজীবীর উপস্থিতিতে অথবা বাসায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের এই নির্দেশনাগুলো দেশের প্রত্যেকটি অভিযুক্তের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

No comments:

Post a Comment